“ভবিষ্যতে কর অব্যাহতির ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকবে” এই ঘোষণা ও প্রেক্ষাপট, প্রস্তাবিত আইন ও চ্যালেঞ্জসহ এনবিআর (NBR) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও বিস্তারিত দিক তুলে দিচ্ছি:- এনবিআর চেয়ারম্যান আগারগাঁওয়ে এনবিআরের নিয়মিত আয়োজন মিট দ্যা বিজনেস অনুষ্টানে ফরেন চেম্বারের সঙ্গে আলোচনায় এই কথা জানান তিনি।
প্রেক্ষাপট ও কারণ:
কর অব্যাহতির অতিরিক্ত ব্যয় (Tax Expenditure) ও রাজস্ব ক্ষতি:
এনবিআর চেয়ারম্যান বলছেন যে, দেশে অনেক বেশি পরিমাণ কর অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে এমনকি এমন অব্যাহতির পরিমাণ বর্তমান রাজস্ব আয়ের সমান বা অতিরিক্ত হতে পারে।
এই অব্যাহতির কারণে সরকারি রাজস্ব সংগ্রহে ঘাটতি হচ্ছে এবং কর‑থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। এর জন্য, কর অব্যাহতির অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা ও অপব্যবহার (lobbying, ব্যক্তিগত প্রভাব, বিশেষ গ্রুপ সুবিধা) রোধ করা জরুরি মনে করছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও আর্থিক সহযোগিতার শর্ত:
এই প্রেক্ষিতে, IMF ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা কর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও বাজেট সংস্কার দাবি করছেন। একটি শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, কর অব্যাহতির ক্ষমতা নির্বাচিত সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
কর সংস্কার ও জিডিপি‑কর অনুপাত বাড়ানো:
কর অব্যাহতির সুবিধা সীমিত করার মাধ্যমে রাজস্বের অনুপাত (Tax to GDP ratio) বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা হবে। ও দীর্ঘমেয়াদে “কর অব্যাহতির সংস্কৃতি (tax‑exemption culture)” ধাপে ধাপে ধ্বংস করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রস্তাবিত নীতি ও কাঠামো (Policy & Framework):
নিচে প্রধান প্রস্তাবিত কাঠামোগত বিন্যাস ও আইনগত উদ্যোগগুলোর সারাংশ দেওয়া হলো:
বর্তমান যেসব ক্ষমতা NBR বা অর্থমন্ত্রনালয়ের আছে (আয়কর আইন, VAT আইন, কাস্টমস আইন ইত্যাদি) থেকে কর অব্যাহতির ক্ষমতা সরিয়ে নিয়ে সংসদের নিষ্ক্রিয় অনুমোদনায় আনতে হবে।
অর্থবিল বা সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে আইনগত রূপ দিতে হবে।
সীমাবদ্ধ মেয়াদ:
নতুন কর অব্যাহতির মেয়াদ সর্বোচ্চ ৫ বছর নির্ধারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
মেয়াদ পেরিয়ে গেলে পুনর্মূল্যায়ন ও পুনঃঅনুমোদন প্রয়োজন হবে।
অস্থায়ী অবস্থা / সংসদ বন্ধ থাকলে:
যদি সংসদ সঞ্চালন করে না, তখন ক্যাবিনেট অনুমোদন সঙ্গে অন্তর্বর্তীভাবে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে, তবে মেয়াদ হবে এক বছরের মধ্যে সীমিত।
এরপর সেই অব্যাহতি সংসদে উপস্থাপন করতে হবে।
চলমান অব্যাহতি ও নো-শেষ তারিখী আদেশ:
যেসব অব্যাহতি বা আদেশ আছে, বিশেষ করে যেগুলোর মেয়াদ নির্ধারিত নয়, সেগুলোকে ৩০ জুন ২০২৬-এর মধ্যে সংসদে উপস্থাপন করতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে বৈধতা বৃদ্ধি, সংশোধন বা প্রত্যাহার।
অর্থাৎ, একাধিক পুরাতন অব্যাহতির পুনর্মূল্যায়ন হবে।
বার্ষিক প্রতিবেদন ও মূল্যায়ন:
প্রতিটি বছর অর্থমন্ত্রীকে সংসদে একটি কর অব্যাহতির (tax expenditure) প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে হবে, যেখানে সব অব্যাহতিকরণ ও তাদের প্রভাব বিশ্লেষণ থাকবে।
প্রতি বছর অব্যাহতির একটি অংশের প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে (কমপক্ষে ১/৫ অংশ)।
অতি জরুরি প্রেক্ষাপটে:
“জরুরি জনস্বার্থ” রক্ষা করার প্রয়োজন হলে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা, ক্যাবিনেট অনুমোদন নিয়ে অস্থায়ীভাবে অব্যাহতি দিতে পারবেন।
তবে সেই অব্যাহতি সেই অর্থবছর শেষ হওয়ার পর বৈধ থাকবে না, এবং নতুন মেয়াদ পেতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে।
এনবিআর চেয়ারম্যানের বক্তব্য ও মনোবৃত্তি:
তিনি বারবার বলছেন যে “কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে” অর্থাৎ, অব্যাহতির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, সাধারণ করদাতাদের সুবিধা দিতে হবে। নতুন কোনো কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না, যদি না তা নিরাপত্তার কারণে অপরিহার্য হয়। ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছেন কর অব্যাহতির দাবি না করতেই ব্যবসা পরিকল্পনা করুক, অর্থনৈতিক বেসিদৃশ্য, লাভসাধকের ভিত্তিতে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক ইচ্ছা (political will) না থাকলে কর প্রশাসনে সুশাসন আসবে না। এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “সরকার আর নিজ ইচ্ছামতে কর অব্যাহতি দিতে পারবে না; সংসদের মাধ্যমে অব্যাহতির বিষয়ে বিবেচনা হবে” অর্থাৎ এই পরিবর্তন শুধু নীতি নয়, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন। তিনি অভ্যর্থনা দিয়েছেন যে, অতীতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা প্রভাব দিয়ে অনেক অব্যাহতি নিতে পারা যেত এখন সেই গেট বন্ধ হবে। উদাহরণ হিসেবে, তিনি উল্লেখ করেছেন যে গ্রামীণ ব্যাংককে tax exemption দেওয়া হয়েছিল, তবে দাবি করেছেন যে তা “বিশেষ সুবিধা” নয়, অন্য সংগঠনগুলোর যে সুবিধা, তা দেওয়া হয়েছে।
কার্যকর হওয়ার সময়সীমা ও প্রক্রিয়া:
নতুন নীতি ২০২৫‑২০২৬ অর্থবছর থেকে কার্যকর হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিছু পরিবর্তন তখনই চালু হবে, তবে আইনগতভাবে সেটি কার্যকর করতে হবে বাজেট আইন বা সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে। সংসদের বাইরে অবস্থা হলে, অস্থায়ীভাবে ক্যাবিনেটের মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে, তবে মেয়াদ সীমিত থাকবে। চলমান অব্যাহতির পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে বিশেষ করে যেসব অব্যাহতির ক্ষেত্রে মেয়াদকাল নির্ধারিত হয়নি যাতে তাদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব যাচাই করা যায়।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া:
অনেক শিল্প, বাণিজ্য গোষ্ঠী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি কর অব্যাহতির দাবি জানাবে, তাদের চাপে নীতি বদলাতে হতে পারে।
বিশেষ খাত (যেমন রপ্তানি, নতুন উদ্যোগ) কর অব্যাহতির দাবি করতে পারে, যা সীমাবদ্ধ করা কঠিন হবে।
আইনগত ও সাংবিধানিক বাধা:
বর্তমানে প্রয়োজন এমন আইন সংশোধন ও নতুন আইন গঠন কাজটি সময়সাপেক্ষ, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ায় বাধা থাকতে পারে।
পুরাতন অব্যাহতি বাতিল করা গেলে যারা তার ওপর নির্ভর করেছিলেন, তারা বিরোধ জানাতে পারে।
অস্থায়ী সরকারের সীমাবদ্ধতা:
সংসদ বন্ধ থাকতে পারে; তখন নির্ভর করতে হবে ক্যাবিনেট অনুমোদনের উপর তবে তার মেয়াদ সীমিত।
জরুরি অব্যাহত অব্যাহতির প্রস্তাব দিতে হবে তবে সেটি সীমিত মেয়াদী হবে।
আন্তঃদপ্তর সমন্বয় ও প্রশাসনিক সক্ষমতা:
NBR, অর্থ মন্ত্রণালয়, আইনদাতা ও সংসদ মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
অব্যাহতির তথ্য, প্রভাব বিশ্লেষণ, প্রতিবেদন প্রস্তুতির জন্য প্রযুক্তি ও তথ্যব্যবস্থা একীভূত করতে হবে।
প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
প্রতিবন্ধী সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব:
কিছু ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির সুযোগ না পেলে বিনিয়োগ হ্রাস পেতে পারে, তবে নীতি সুষম রাখলে তার প্রভাব হ্রাস হবে।
শিল্প পুনর্গঠন ও উদ্ভাবনী উদ্যোগকে প্ররোচিত করতে বিশেষ প্রণোদনা ছাড়াও সহায়ক নীতি প্রয়োজন হবে।
Leave a Reply